কেন বাংলাদেশের টেক ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো ম্যানেজারের এত অভাব?
আমাদের টেক ইন্ডাস্ট্রিতে এটি একটি অতি পরিচিত দৃশ্য। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, যিনি তার টেকনিক্যাল দক্ষতা, প্রবলেম সলভিং এবং ডেডিকেশন দিয়ে সবার নজর কেড়েছেন, তাকে পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার বানিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তার টিমের সদস্যদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে অভিযোগে রূপ নেয়। যে মানুষটি একসময় সবার অনুপ্রেরণা ছিলেন, তিনিই এখন হয়ে উঠেছেন হতাশার কারণ।
এই ঘটনাটি এতটাই নিয়মিত ঘটে যে, আমরা অনেকেই একে স্বাভাবিক নিয়ম বলে ধরে নিয়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের সেরা টেকনিক্যাল ট্যালেন্টরা কেন ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে এসে এমন হোঁচট খাচ্ছেন? এর পেছনের কারণ কী এবং এই চক্র থেকে বের হওয়ার উপায়ই বা কী?
মূল সমস্যা: পিটার প্রিন্সিপলের ফাঁদ
এই পরিস্থিতির একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দেয় লরেন্স জে. পিটারের বিখ্যাত পিটার প্রিন্সিপল
(Peter Principle)। তত্ত্বটি সহজ ভাষায় বলে:
“একটি প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক কর্মীকে তার দক্ষতার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরপর তাকে এমন একটি পদে উন্নীত করা হয়, যেখানে তার দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে এবং সেখানেই তিনি আটকে যান।”
বিষয়টি ভেঙে বললে, একজন ইঞ্জিনিয়ার ভালো কোড করেন, কঠিন সমস্যা সমাধান করেন, তাই তাকে সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার করা হয়। সেই পদেও তিনি দারুণ কাজ করেন, তাই তাকে টেক লিড বানানো হয়। কিন্তু এরপর যখন তাকে ম্যানেজার করা হয়, তখন খেলার নিয়ম পুরোপুরি বদলে যায়। কোডিং, আর্কিটেকচার বা ডিবাগিংয়ের দক্ষতা দিয়ে টিম ম্যানেজমেন্ট, মেন্টরিং, বাজেট পরিকল্পনা বা মানুষের আবেগ বোঝার মতো কাজগুলো করা যায় না।
এই নতুন পদের জন্য যে ভিন্ন ধরনের দক্ষতা (Soft Skills) প্রয়োজন, সেদিকে নজর না দিয়েই কেবল অতীতের পারফর্ম্যান্সের উপর ভিত্তি করে পদোন্নতি দেওয়ার ফলেই এই সমস্যার জন্ম হয়। নতুন পদে এসে তিনি আর আগের মতো সফল হতে পারেন না, ফলে তার পদোন্নতিও থেমে যায়। তিনি একজন অদক্ষ ম্যানেজার হিসেবেই থেকে যান এবং তার অধীনে থাকা টিমটিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
একজন অদক্ষ ম্যানেজারের প্রভাব কতটা মারাত্মক?
একজন ভালো ইঞ্জিনিয়ার যখন একজন অদক্ষ ম্যানেজারে পরিণত হন, তখন তার প্রভাব শুধু তার নিজের ক্যারিয়ারেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং পুরো টিমের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
১. মাইক্রোম্যানেজমেন্ট: যিনি নিজে একজন সেরা কোডার ছিলেন, তার পক্ষে টিমের কোডিংয়ের খুঁটিনাটি থেকে নিজেকে দূরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে তিনি মাইক্রোম্যানেজমেন্ট শুরু করেন, যা টিমের সৃজনশীলতা এবং স্বাধীনতা নষ্ট করে দেয়।
২. যোগাযোগের ঘাটতি: টেকনিক্যাল আলোচনায় পটু হলেও, টিমের সদস্যদের ক্যারিয়ার গোল, ব্যক্তিগত সমস্যা বা মোটিভেশন নিয়ে আলোচনা করার মতো কমিউনিকেশন স্কিল হয়তো তার থাকে না।
৩. মেন্টরশিপের অভাব: তিনি হয়তো বলতে পারেন কীভাবে একটি সমস্যার সমাধান করতে হবে, কিন্তু একজন জুনিয়র সদস্যকে নিজে থেকে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করার মতো মেন্টরশিপ তিনি দিতে পারেন না।
৪. বিষাক্ত কর্মপরিবেশ (Toxic Culture): ম্যানেজারের অদক্ষতার কারণে টিমের মধ্যে অসন্তোষ, কাজে অনীহা এবং একে অপরের উপর দোষারোপের মতো পরিবেশ তৈরি হতে পারে, যা প্রতিভাবান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে উৎসাহিত করে।
এই সমস্যা শুধু বড় কোম্পানিতেই নয়, ছোট স্টার্টআপগুলোতেও প্রকট। অনেক টেক স্টার্টআপের ফাউন্ডাররা নিজেরা চমৎকার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু যখন টিম ৫ জন থেকে ১৫ বা ২০ জনে পৌঁছায়, তখন প্রোডাক্ট তৈরির পাশাপাশি মানুষ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও চলে আসে। এই নতুন দায়িত্বে মানিয়ে নিতে না পারার কারণে অনেক সম্ভাবনাময় স্টার্টআপও ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে।
সমাধানের পথ: সাফল্যের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা
এই চক্র ভাঙার জন্য আমাদের ক্যারিয়ারের অগ্রগতি বা 'সাকসেস' নিয়ে গতানুগতিক ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ম্যানেজার হওয়াই যে ক্যারিয়ারের একমাত্র অগ্রগতির পথ নয়, এই সংস্কৃতিটি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
এর জন্য সবচেয়ে কার্যকর মডেল হলো ডুয়াল ক্যারিয়ার ট্র্যাক (Dual Career Path)।
ট্র্যাক ১: ইন্ডিভিজুয়াল কন্ট্রিবিউটর (Individual Contributor - IC) ট্র্যাক
এই পথে একজন ইঞ্জিনিয়ার ম্যানেজার না হয়েও ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে পারবেন। তিনি তার টেকনিক্যাল দক্ষতাকে আরও শাণিত করে টেক লিড, স্টাফ ইঞ্জিনিয়ার, প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার বা ডিস্টিংগুইশড ইঞ্জিনিয়ারের মতো পদে যেতে পারবেন। এই পদগুলোর দায়িত্ব হলো সবচেয়ে জটিল টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা, নতুন প্রযুক্তির গবেষণা করা এবং পুরো প্রতিষ্ঠানে টেকনিক্যাল মেন্টরশিপ প্রদান করা। তাদের বেতন এবং সম্মান একজন ম্যানেজারের সমতুল্য বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে।
ট্র্যাক ২: পিপল ম্যানেজার (People Manager) ট্র্যাক
এই পথটি তাদের জন্য, যাদের মানুষের সাথে কাজ করতে, টিমকে வழி দেখাতে এবং তাদের ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করতে ভালো লাগে। যারা টেকনিক্যাল কাজের চেয়ে স্ট্র্যাটেজি, পরিকল্পনা এবং পিপল ম্যানেজমেন্টে বেশি আগ্রহী, তাদের এই পথে আসা উচিত।
এই দুটি পথকে সমানভাবে গুরুত্ব দিলে, আমার মতো যারা অন্তর্মুখী বা টেকনিক্যাল কাজেই বেশি আনন্দ পান, তারা কেবল সামাজিক চাপ বা বেতন বৃদ্ধির জন্য ম্যানেজার হওয়ার কথা ভাববেন না। অন্যদিকে, যারা সত্যিকারের লিডার, তারাই সঠিক भूमिका পালন করার সুযোগ পাবেন।
শেষ কথা
কোনো মানুষকে পদোন্নতি দেওয়ার আগে শুধু তার বর্তমান পারফর্ম্যান্স দেখলে চলবে না। বরং ভাবতে হবে, নতুন পদের জন্য যে দক্ষতাগুলো প্রয়োজন, তা তার মধ্যে আছে কি না বা তিনি তা অর্জন করতে আগ্রহী কি না। ম্যানেজেরিয়াল রোলের জন্য ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ায় তার লিডারশিপ, এমপ্যাথি এবং কমিউনিকেশন স্কিলকে কঠোরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
সঠিক মানুষকে সঠিক দায়িত্বে বসানোর মাধ্যমেই কেবল আমরা দক্ষ ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিত করতে পারি এবং এমন একটি টেক-ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারি, যেখানে ইঞ্জিনিয়ার এবং ম্যানেজার উভয়ই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হবেন।
Comments
Leave a Comment